১০.৪.১ চারটি মৌলিক বল
পৃথিবীতে কত ধরনের বল আছে জিজ্ঞেস করা হলে তোমরা নিশ্চয়ই বলবে অনেক ধরনের। কোনো কিছুকে যদি ধাক্কা দিই, সেটা একটা বল, ট্রাক যখন বোঝা টেনে নিয়ে যায়, সেটা একটা বল, ঝড়ে যখন গাছ উপড়ে পড়ে, সেটা একটা বল, চুম্বক যখন লোহাকে আকর্ষণ করে সেটা একটা বল, বোমা বিস্ফোরণে যখন ঘরবাড়ি উড়িয়ে দেয়, সেটা একটা বল, ক্লেন যখন কোনো কিছুকে টেনে তোলে সেটা একটা বল। একটুখানি সময় দিলেই এ রকম নানা ধরনের বলের তোমরা একটা বিশাল তালিকা তৈরি করতে পারবে।কিন্তু চমকপ্রদ ব্যাপারটি কী জান? প্রকৃতিতে মাত্র চার রকমের বল রয়েছে, ওপরে যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে বিশ্লেষণ করা হলে দেখা যাবে, এগুলো ঘুরে-ফিরে এই চার রকমের বাইরে কোনোটা নয়। আসলে মৌলিক বল মাত্র চারটি। সেগুলো হচ্ছে: মহাকর্ষ বল, তড়িৎ চৌম্বক বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল ও সকল নিউক্লীয় বল।
মহাকর্ষ বল (Gravitation)
এই সৃষ্টিজগতের সকল বস্তু তাদের ভরের কারণে একে অপরকে যে বল দিয়ে আকর্ষণ করে, সেটাই
হচ্ছে মহাকর্ষ বল। এই মহাকর্ষ বলের কারণে গ্যালাক্সির ভেতরে নক্ষত্ররা ঘুরপাক খায় কিংবা সূর্যকে
ঘিরে পৃথিবী ঘোরে, পৃথিবীকে ঘিরে চাঁদ ঘোরে। পৃথিবীর মহাকর্ষ বল যখন আমাদের ওপর কাজ করে, আমরা সেটাকে বলি মাধ্যাকর্ষণ। এই মাধ্যাকর্ষণ বল আমাদেরকে নিচের দিকে (পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে) টেনে রেখেছে এবং এর কারণেই আমরা নিজেদের ওজনের অনুভূতি পাই। পদার্থবিজ্ঞানের একটি চমকপ্রদ বল হচ্ছে মহাকর্ষ বল। ভর আছে সেরকম যেকোনো বস্তু অন্য বস্তুকেমহাকর্ষ বল দিয়ে আকর্ষণ করে।
তড়িৎ চৌম্বক বল বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল (Electromagnetic Force)
চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে সেটা দিয়ে কাগজের টুকরোকে আকর্ষণ করা বা চুম্বক দিয়ে অন্য চুম্বককে আকর্ষণ-বিকর্ষণ আমাদের অনেকেই কখনো না কখনো করেছি। যদিও তড়িৎ বা বিদ্যুৎ এবং চুম্বকের বলকে আলাদা ধরনের বল মনে হয়, আসলে দুটি একই বল শুধু দুইভাবে দেখা যায়। শুধু এই বলটা আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ দুটোই করতে পারে অন্যগুলো শুধু আকর্ষণ করতে পারে বিকর্ষণ করতে পারে না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তুলনায় এটা অনেক শক্তিশালী (১০৩৬ গুণ বা ট্রিলিওন ট্রিলিওন ট্রিলিওন গুণ শক্তিশালী!) কথাটা যে সত্যি সেটা নিশ্চয়ই তোমরা সহজেই অনুমান করতে পারবে। কারণ যখন তুমি একটা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে একটা কাগজকে আকর্ষণ করে তুলে নাও, তখন কিন্তু সেই কাগজটাকে পুরো পৃথিবী তার সমস্ত ভর দিয়ে তৈরি মাধ্যাকর্ষণ বল দিয়ে টেনে রাখার চেষ্টা করে, তবুও তোমার চিরুনির অল্প একটু বিদ্যুৎ সেই বিশাল পৃথিবীর পুরো মাধ্যাকর্ষণকে হারিয়ে দেয়।
দুর্বল নিউক্লীয় বল (Weak Force)
এটাকে দুর্বল বলা হয় কারণ এটা তড়িৎ চৌম্বক বল থেকে দুর্বল (প্রায় ট্রিলিওন গুণ) কিন্তু মোটেও মহাকর্ষ বলের মতো এত দুর্বল নয়। মহাকর্ষ এবং তড়িৎ চৌম্বক বল যেকোনো দূরত্ব থেকে কাজ করতে পারে কিন্তু এই বলটা খুবই অল্প দূরত্বে (১০-১৮ “m” ) কাজ করে। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে যে বেটা (B) রশ্মি বা ইলেকট্রন বের হয় সেটার কারণ এই দুর্বল নিউক্লীয় বল।
সবল নিউক্লীয় বল (Strong Nuclear Force)
এটি হচ্ছে সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী বল, তড়িৎ চৌম্বক বল থেকেও একশগুণ বেশি শক্তিশালী কিন্তু এটাও খুবই অল্প দূরত্বে (১০-১৫ “m” ) কাজ করে। পরমাণুর কেন্দ্রে যে নিউক্লিয়াস রয়েছে তার ভেতরকার প্রোটন এবং নিউট্রনের নিজেদের মাঝে এই প্রচণ্ড শক্তিশালী বল কাজ করে নিজেদের আটকে রাখে। প্রচণ্ড বলে আটকে থাকার কারণে এর মাঝে অনেক শক্তি জমা থাকে তাই বড় নিউক্লিয়াসকে ভেঙে কিংবা ছোট নিউক্লিয়াসকে জোড়া দিয়ে এই বলের কারণে অনেক শক্তি তৈরি করা সম্ভব। নিউক্লিয়ার বোমা সে জন্য এত শক্তিশালী। সূর্য থেকে প্রাপ্ত আলো ও তাপ এই বল দিয়ে তৈরি হয়।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই চার ধরনের বলের মূল এক জায়গায় এবং তাঁরা সবগুলোকে এক সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। তড়িৎ চৌম্বক (বিদ্যুৎ চৌম্বকীয়) এবং দুর্বল নিউক্লিয়ার বলকে এর মাঝে একই সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে এবং সেটি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি আকাশছোঁয়া সাফল্য। (কাজেই তুমি ইচ্ছে করলে বলতে পার বল তিন ধরনের: মহাকর্ষ, ইলেকট্রো উইক (Electro- weak) এবং নিউক্লিয়ার বল। (কেউ এটাকে ভুল বলতে পারবে না) অন্যগুলোকেও একসূত্রে গাঁথার জন্য বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
তোমরা যখন তোমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা কাজে বল ব্যবহার কর তখন তোমাদের মনে হতে পারে কোনো কোনো বল প্রয়োগ করতে হলে স্পর্শ করতে হয় (ক্রেন দিয়ে ভারী জিনিস তোলা, কোনো কিছুকে ধাক্কা দেওয়া, কিংবা চলতে চলতে ঘর্ষণের জন্য চলন্ত বস্তুর থেমে যাওয়া) আবার তোমরা লক্ষ করেছ, কোনো কোনো বল প্রয়োগের জন্য স্পর্শ করতে হয় না (কোনো কিছু ছেড়ে দিলে মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্য নিচে পড়া, চুম্বকের আকর্ষণ) কাজেই আমরা বলকে স্পর্শ এবং অস্পর্শ দুই ধরনের বলে ভাগ করতে পারি। স্পর্শ বলের উদাহরণ হিসেবে আমরা ঘর্ষণ বল নিয়ে আলোচনা করব।
যদিও আমরা ঘর্ষণ বলকে স্পর্শ বলের উদাহরণ হিসেবে আলোচনা করছি, কিন্তু তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমরা যেখানে স্পর্শ করছি বলে ধারণা করছি, সেখানে কিন্তু পরস্পরের অণু-পরমাণু, তাদের খিরে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন সরাসরি স্পর্শ দিয়ে নয়, তাদের তড়িৎ চৌম্বক বল দিয়ে একে অন্যের সাথে কাজ করছে। অন্য কথায় বলা যায়, আমরা যদি আণবিক পারমাণবিক পর্যায়ে চলে যাই, তাহলে সব বলই অস্পর্শক। এক পরমাণু অন্য পরমাণুকে আকর্ষণ-বিকর্ষণ করে দূর থেকে, তাদেরকে আক্ষরিক অর্থে স্পর্শ করতে হয় না ।